শান্তির জন্যে চতুর্থ বিশ্বের উজ্জ্বল নাম শেখ হাসিনা

শান্তির জন্যে চতুর্থ বিশ্বের উজ্জ্বল নাম শেখ হাসিনা

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৬ তম অধিবেশন। ভাষণ দিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বশান্তি রক্ষায় ৬ দফা শান্তির মডেল ঘোষণা দিলেন। বললেন, ‘অভিজ্ঞতার আলোকে আমি আপনাদের সামনে একটি শান্তির মডেল দিতে চাই। এটি একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যেখানে গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। দফাগুলো হচ্ছে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্য দূরীকরণ, বঞ্চনার লাঘব, ঝরেপড়া মানুষদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন। সেদিন তিনি বলেছিলেন ‘এই মডেলের মূল বিষয় হচ্ছে সব মানুষকে সমান চোখে দেখা এবং মানবিক সামর্থ্য উন্নয়নের কাজে লাগানো। একমাত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

২০১১ থেকে ২০২৩, একযুগ সময় যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, দেখবো তিনি শান্তির পথেই হাঁটছেন। শুধু নিজে হাঁটছেন তা নয় বিশ্ববাসীকে নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছেন। ওই অধিবেশনেই তিনি শান্তির ৬দফা শান্তির   মডেলটি বিশ্ববাসীকে গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছিলেন। অথচ তখনো ইউক্রেন যুদ্ধ আসেনি। চীন বিরোধী কোয়াড জোট অতটা আলোচিত হয়নি। তখনই তিনি বুঝেছিলেন আগামী দিনে নিরপেক্ষ তেকে বিশ্ব শান্তি রক্ষা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। 

এখন আসি আজকের বিশ্বে। দীর্দিন ধরে পৃথিবী তিন ধারায় বিভক্ত। নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র চীন ও রাশিয়া। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির অঙ্কটাকে একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, গত এক যুগের  ভূরাজনীতিতে আরেকটি নতুন বলয় তৈরি হচ্ছে। যারা যুদ্ধ বা আগ্রাসন মুক্ত পৃথিবী চাইছে। এর ফলে তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্ব’ হয়ে উঠেছে ‘গ্লোবাল সাউথ’ নামের এক নতুন বলয়। বিশেষ করে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর। মার্কিন যৌথ বাহিনী প্রধান জেনারেল মার্ক মিলি ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকার বলেছিলেন, ‘টুডে উই আর ইন এ ট্রাই-পোলার ওয়ার্ল্ড। এটা বোধ হয় এখন দুর্বল হয়ে গেলো।  অবশ্য ৩০ বছর ধরে যারা বিশ্বকে ইউনিপোলার বা এক মেরু ভাবছেন তাদের জন্যে এটা দুর্বল ভাবা খানিকটা বিস্ময় তো বটেই। 

যত বিস্ময়ই হোক, ইউক্রেনে রুশ আক্রমণকে ঘিরে যে মেরুকরণ ঘটেছে, তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বিশ্বরাজনীতির একটি চতুর্থ স্তম্ভ জমাট বাঁধতে শুরু করে। যাকে তারা তৃতীয় বিশ্ব বিশ্ব বলতেন তা এখন পরিণত হচ্ছ ‘গ্লোবাল সাউথ’নামে পরিচিত। বাংলায় আমরা বলতে পারি ‘বৈশ্বিক দক্ষিণ। ইউক্রেনে রুশ হামলা ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয়দের জন্য বড় ধরনের আঘাত। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তারা ফের এককাট্টা হয়, ইউক্রেনের পক্ষে এক ‘প্রক্সি’ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিম এক হলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ভিন্ন পথ বেছে নেয়। এই যুদ্ধ তাদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী, সেই যুক্তি মাথায় রেখে দক্ষিণের দেশগুলো একক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এক যুগ আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন। 

আফগানিস্তান-ইরাক যুদ্ধে অধিকাংশ দক্ষিণ দেশ মার্কিন নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। ইউক্রেনের বেলায় আর তা হলো না।  রাশিয়ার হামলা তারা সমর্থন করল না বটে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান সত্ত্বেও নিজেদের এই যুদ্ধে জড়াল না। বৈশ্বিক দক্ষিণের ৫০টির বেশি দেশ জাতিসংঘে ইউক্রেন প্রশ্নে ভোটদানে বিরত থাকে। আপাতত বৈশ্বিক দক্ষিণের নীতিগত ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানের নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, রুশ-মার্কিন ঠান্ডাযুদ্ধ, চীন-ভারত যুদ্ধ বা চীন-তাইওয়ানের কূটনৈতিক টানাপোড়েন কিংবা সম্প্রতি বাস্তবতা সামনে রাখলে দেখা যায় সহাবস্থানের পররাষ্ট্রনীতি কতটা দরকার। তাই ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতির চতুর্থ বলয়। এই বিশ্বরাজনীতি বোঝার জন্যে বাংলাদেশকে আর এত মাথা ঘামাতে হয়নি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বঙ্গবন্ধু তাঁর পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে দেন। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। সেই নীতি আজ সারা বিশ্বে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এর আলোকেই ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৬ তম সভায় দিয়ে দেন তাঁর ৬ দফা। এর পর থেকে তিনি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতিতে অনন্য নজির রাখছেন। 

এর মধ্যে শেখ হাসিনার সামনে এসেছে চীনের বিশ্বায়ন প্রকল্প,  বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে একচোখা পশ্চিমানীতি এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের উল্টো সুরের গান। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সচেতনভাবেই তার ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছে। তাঁর এই জোটে যোগ দেয়ার প্রশ্নে ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখায় বাংলাদেশ স্পষ্ট জানিয়েছে, এ জোটের অর্থনৈতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অন্যদেশকে সহযোগিতা করতে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। তিনি বলেছেন বাংলাদেশ যে বিশেষ কোনো দেশ বা জোটের পক্ষে নয়। 

বাংলাদেশ কিন্তু চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও যুক্ত হয়েছে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। সেখানে ভূ-রাজনীতির অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপরই বেশি জোর দেন শেখ হাসিনা। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও একত্রীকরণ নীতিতে এক বড় ধরণের পরিবর্তন এনেছেন শেখ হাসিনা। যেকারণে তিনি এখন প্রভাব বিস্তারকারী আঞ্চলিক নেতা। সন্ত্রাসবাদ, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ এই অঞ্চলে কিছু অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই অঞ্চলের দেশগুলোকে এক করার বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। আর এই সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গিয়েই দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে চলে গেছেন তিনি।   

বিভিন্ন গণমাধ্যমের বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব। এর ফলে, তাঁকে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন আঞ্চলিক ফোরামে জড়িত হতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক। রয়েছে বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন বিমসটেক। তাঁর কূটনৈতিক সাফল্যে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিসমটেক-এর স্থায়ী সচিবালয়। 

ভারত ও চীনের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দীর্দিনের। শেখ হাসিনার কূটনৈতিক তৎপরতায় দুই দেশের সাথেই বাংলাদেশ নিজের ভালো সম্পর্ক ধরে রেখেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সমানতালে কীভাবে সম্পর্ক ভালো রাখলেন তিনি? কূটনীতি বিশ্লেষেকরা বলেন, শেখ হাসিনা জানেন,  বাংলাদেশের কাছে ভারত এবং চীনের চাহিদা ভিন্ন-ভিন্ন। ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক। তাই তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের ক্ষেত্রে ভারতকে অভূতপূর্ব সহায়তা করেন। বাংলাদেশ থেকে ইসলামী জঙ্গিবাদ বিস্তার হয়ে সেটি যেন, ভারতকে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে সেজন্যও পদক্ষেপ নেয় হাসিনা সরকার। পাশাপাশি সমর্থন দিয়েছেন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভসেও। 

২০১৮ সালে ভারত ও চীনের সঙ্গে একইসাথে মেরিটাইম খাতের সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের  কক্সবাজারে, সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারত এবং চীন উভয়ের আগ্রহ দেখায়।  কিন্তু একপক্ষকে এ কাজ দেয়া হলে অন্যপক্ষ অখুশি হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে কোনো পক্ষকেই তিনি এই কাজ দিতে রাজি হননি।  

শেখ হাসিনা বার বার প্রমাণ করেছেন, বর্তমান বিশ্বে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহাবস্থান দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে নতুন বলয় গ্লোবাল সাউথকে যদি এগিয়ে যেতে হয়, তাহলে গ্রহণ করতে হবে বাংলাদেশের মতো ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলাই যায় ট্রাই পোলার বিশ্বের বিপরীতে কোয়াড্রা পোলার বিশ্বের শেখ হাসিনার হাত ধরেই এগোতে হবে।    


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *