লক ডাউন ও ঈশিতাদের বিরল সময়

লেখক মোঃ জয়নাল আবেদীন

করোনা ভাইরাস যখন বিশ্বকে নাকানি চুবানী দিচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে একের পর এক মৃত্যুর সংবাদ আসছে বিভিন্ন মাধ্যমে। আর দিন দিন মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ করোনা আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর, হতদরিদ্র থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন কোনোরকমে দিন পার করছেন। লকডাউনে থেমে আছে পুরো বিশ্ব। অর্থনীতিতে মারাত্মক ঝাঁকুনি দিচ্ছে, পিছিয়ে যাবে উন্নত, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো। এক মূহুর্তে যেন পৃথিবীর সব অলিগলি নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। নেই মিছিল, মিটিং সমাবেশ। নেই গণজমায়েত, আড্ডা। আর শত দুঃখ কষ্টের দিনপার হলেও বেরিয়ে আসে কিছু মানুষের বাস্তব ঘটনা।
বার আসা যাক মূল গল্পে, যেখানে এক নববধূর আকাঙ্খা উঠে এসেছে। শহুরে ছেলে রাহুল ও গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে ঈশিতা পারিবারিক সূত্রে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই বিয়েতে দুই পরিবার ও তাদের এলাকায় খুঁশির জোয়ার। কেননা ঈশিতার মত মেয়ে পাওয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রায় অসম্ভব। যেমন ভদ্র; তেমনি সহজ আর সরল। ঈশিতার স্বভাব চরিত্র ভালো হওয়ার কারণে সবাই তাকে পছন্দ করে। ঈশিতা আর রাহুলের বিয়ে হলো সবেমাত্র তিনদিন গেল। এই তিনদিন রাহুল-ঈশিতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যেন একে অপরের শত জনমের চেনা।

বার কর্মময় জীবনে রাহুল ব্যস্ত হতে শুরু করলো। রাহুল তার কাজের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দায়িত্বশীল। রাহুলের কাজের প্রশংসা করতে অফিসের বসের আলসেমি নেই। সকাল আটটার সময় রাহুলের অফিস কার্যক্রম শুরু হয়। অফিস কার্যক্রম শেষে বাড়িতে ফিরতে ঘড়ির কাঁটা তখন রাত এগারোটায়। বাসায় ফিরে রাহুল ফ্রেশ হয়ে ডিনার সেরে নেন। সারাদিন ক্লান্তিময় রাহুল বিছানায় গাঁ দিতেই নিদ্রার ছাপ স্পষ্ট হয়। বিছানায় শোয়ার আগে ঈশিতার সঙ্গে দু-এক লাইন কথা বলে রাহুল হারিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।
      এদিকে ঈশিতা রাহুলের ব্যস্ততা দেখে কোনো কথা বলার সুযোগ পায় না। ঈশিতা রাহুলের সঙ্গে একি বিছানায় থাকলেও তার কাছে নিজেকে একা একা মনে হয়। রাহুল যেন ঈশিতার অতি নিকটে থেকেও নেই- এমন সময় যাচ্ছে তার। ঈশিতা চায় তার স্বামীর সঙ্গে ঘন্টাখানেক সময় কাটাতে, আনন্দ, উল্লাসে মেতে উঠতে। কিন্তু স্বামী রাহুলের কর্মব্যস্ততায় তা হয়ে উঠছে না। ঈশিতা শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে যতক্ষণ কথা বলে ততক্ষণ তার মন মানসিকতা ভালো থাকে। ঈশিতা যখন একা থাকে তখন আনমনা হয়ে শুধু ভাবে আর বলে- আমি শুধুই একা। এই একাকীত্ব জীবন দূর করতে একজন সঙ্গী হিসেবে ঠিক করে দিয়েছেন মা-বাবা। কিন্তু সেই অন্য এক একাকী জীবনই যেন ভর করেছে মিষ্টি মুখের ঈশিতা। ঈশিতার উদাস মনে কি বলছে বার বার? রাহুল কি আমাকে পরিবারের চাপে বিয়ে করল নাকি রাহুলের জীবনে টাকাই সব। নাকি রাহুল রোমান্টিকতা বোঝে না, ভালোবাসা বোঝে না- নিজের কাছেই প্রশ্ন করতে থাকে ঈশিতা। তার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা এসব উত্তর একমাত্র রাহুল- ই দিতে পারবে।
দাম্পত্য জীবনে ঈশিতা তিনদিন সময় পেয়েছে রাহুলের কাছ থেকে। সেই মধুমিলনের তিনদিন ঈশিতার কাছে তিনযুগ মনে হয়। ঈশিতার এই একাকীত্ব জীবনে সেই তিনদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু রাহুলের এই কর্মব্যস্ততার কারণে ঈশিতা তাকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো- তুমি কি আমায় সত্যিকার অর্থে ভালোবাসো? রাহুল বললো- হঠাৎ তোমার এই প্রশ্ন? মনের মধ্যে রহস্য জেগে উঠেছে। ঈশিতা বললো- বিয়ের পর সেই তিনদিন তুমি আমাকে সময় দিলেও; এখন তুমি আর তুমি নেই, তুমি টাকার মধ্যে ডুবে আছো। আমার মনে হয় তোমার বস আর তোমার অফিস আমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাহুল এবার সিরিয়াস হয়ে বলল- কি সব বলছো? এবার ঈশিতা বলে- বলো… কি দোষ করেছি আমি, কি কারনে অকারণে আমাকে তুমি অবহেলা করছো? রাহুল ঈশিতার কথা শুনে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। রাহুল কি বলবে সে ঈশিতার কথা শুনে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাহুল বললো- দ্যাখো ঈশিতা অর্থ ছাড়া এই পৃথিবীতে কোনো দাম নেই। এছাড়া ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করতে হবে আমাকে আর তোমাকে। আমার মধ্যেও মানবিকতা, আদর, ভালোবাসা রয়েছে; আমি রোবট নযই। আর অফিস শেষ করে আসার পর কোনো সময় থাকে না তোমার সাথে গল্প করার। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর বিছানা পাওয়া মাত্রই নিদ্রায় চলে যায়।
রাহুলের কথার বেড়াজালে ঈশিতা বলে উঠলো- দ্যাখো শত ব্যস্ততা আর অর্থ চিন্তার পাশাপাশি নিজের বউকেও সময় দিতে হয়। তুমি জানো না নারীরা কেন পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। রাহুল বললো- ঈশিতা তুমি এমন মেয়ে নওে যে আমাকে ধোঁকা দিবে। তোমার ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই; অভিযোগ নেই। তুমি কখনোই আমার সাথে এমন আচরণ অবিশ্বাসী কিছু করবে না বলেই আমার বিশ্বাস। রাহুল ঈশিতার কষ্টের কথা শুনে এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো যে- পুরো পৃথিবী জুড়ে যদি এই কর্মব্যস্ততা কয়েকমাসের জন্য বন্ধ থাকতো তাহলে তোমার সব অভিমান আমি দূর করে দিতাম। মনের গহীনে যত কথা লুকিয়ে আছে তোমার বুকে জড়িয়ে ধরে শুনতাম। ঈশিতা রাহুলের কথা শুনে আর কিছুই বলেনি। কারণ সে রাহুলের বিশ্বাস কোনোভাবেই ভাঙ্গতে পারে না। ঈশিতা আবার মনে মনে ভাবলো রাহুল কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে হয়তো আমাকে সময় দিতে পারে না। কিন্তু সেতো আর খারাপ কাজে সময় ব্যবহার করছে না। এই বলে ঈশিতা নিজের মনকে সান্তনা দিতে থাকলো। ঈশিতা আর রাহুলের দাম্পত্য জীবন এভাবে চলতে থাকলো।
তিনমাস যাওয়ার পর চিনের উহানে শুরু হলো প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনার খেলা। নভেল করোনা ভাইরাস ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ক পর্যায়ে বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাস হানা দেয়। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশে শুরু হয় লকডাউন। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত এই লকডাউনে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আর এই লকডাউনে স্বস্তি বোধ করছে রাহুল আর ঈশিতা। এ যেনো আতংকের মধ্যেও কারো জীবনে আশার ফুল ফুটেছে। ঈশিতা রাতের বিছানায় সেই রাহুলকে ফিরে পাবে- এই ভেবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে। ঈশিতা বলে উঠলো- করোনা মরণঘাতী ভাইরাস হলেও আমার জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছে স্বামীর আদর, ভালোবাসা, রোমান্টিকতা। দাম্পত্য জীবনে আমি যেন সেই আগের মত সুখের স্বর্গে বাস করছি। ঈশিতার মত এমন লক্ষ-কোটি নববধূ আছেন। যারা শুধু স্বামীর অর্থের চিন্তা করে না। তারা চায় হাঁসি-খুশিতে স্বামীর সঙ্গে দিন কাটিয়ে দেয়ার জন্য। সুতরাং কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি নিজের স্ত্রীকে সময় দিন…..।
   

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *