নগরের সড়কে দুর্ঘটনায় বেঘোরে ঝরছে তাজা প্রাণ, ৫ বছরে ৩৫০

বছরকে বছর দেশে সড়ক যোগাযোগের উন্নয়নে বাড়ছে বরাদ্দ। নির্মাণ হচ্ছে নতুন নতুন সড়ক। পাশাপাশি সংস্কার হয় পুরাতন সড়কও। সেইসঙ্গে সড়ক দুঘর্টনা নিয়ন্ত্রণে আছে কঠোর আইন। কিন্তু তাতেও থেমে থাকছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। এই সড়কেই বেঘোরে ঝরে যাচ্ছে শত শত তাজা প্রাণ।
আইন থাকলেও না মানার প্রবণতায় সড়কে মৃত্যু না কমে বরং বছরের পর বছর ক্রমাগতহারে বেড়েছে। গত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। গত ৫ বছরে ৪৩৯টি দুর্ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরের সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৫০ জন। যদিও এসকল দুর্ঘটনার সংখ্যা, মামলা ও প্রাণহানির তথ্য পুলিশ সংরক্ষণ করে। কিন্তু এসকল মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের সাজা পাওয়ার সঠিক চিত্রও জানা নেই কারও।
চমেক হাসপাতালের তথ্যমতে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন এবং আহত হয়েছেন ১০ জন। তবে একইসময়ে জানুয়ারিতে পুলিশের কাছে ১১ টি সড়ক দুর্ঘটনার মামলা হয়েছে। তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের এবং আহত হয়েছে ৫ জন।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে সড়কে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তবে বিগত কয়েক বছর মোটরসাইকেল এবং ছোট যানবাহনের চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে দুর্ঘটনা আরও বাড়ছে। এর সাথে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন এবং দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকারের তরফ থেকে মহাসড়ক এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ছোট ও অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদৌতে তা বাস্তবায়িত হয়নি।

সড়কে মৃত্যুর ঘটনায় করা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলার হিসাব থেকে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানির তথ্য সংরক্ষণ করে পুলিশ। তাদের তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম নগরে গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যর ঘটনা ঘটেছে গতবছর অথার্ৎ ২০২১ সালে। এরপরে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ সালে। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৯৭ জনের এবং আহত হয়েছে ৫০ জন। এর আগের বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬২ জন এবং আহত হয়েছে ৩৮ জন। এক বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। এর আগের বছর ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৩৩ জন। তার আগের ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭১ জনের মৃত্যু হয় এবং আহত হয় ৩১ জন। গত পাঁচ বছরের তুলনায় সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যু কম ছিল ২০১৭ সালে। সে বছর সড়কে মৃত্যু হয় ৫৭ জনের এবং আহত হন ২০ জন। অবশ্য, পুলিশের সংরক্ষিত হিসাবের সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্যে বেশ পার্থক্য থাকে। তাদের হিসাবে দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিমাণ আরও বেশি।

নিরাপদ সড়ক চাই এর তথ্যমতে, গত বছরে (২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) চট্টগ্রাম জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫২৯টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৩৬৩ জন এবং আহত ৬ হাজার ৩৬৭ জন।

যদিও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন থাকলেও এর কার্যকারীতা নামে মাত্র। ত্রুটির্পূণ যানবাহনের পাশাপাশি কোনো রকম বাছবিচার না করেই মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দিয়ে চলেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অথচ সেভাবে মোটরসাইকেলে হেলমেট নিশ্চিত করা, গতিনিয়ন্ত্রণ এবং চালকের লাইসেন্স থাকার বিষয়ে জোরালো নজরদারি রাখেনি কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল অনুষদের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত সিভয়েসকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর আইন হয়েছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। এমনকি নিয়ম মানার প্রবণতাও কারও মাঝে নেই। কোনো কার্যকর ব্যবস্থা ছাড়া কি দুর্ঘটনা কিংবা মৃত্যু কমে যাবে? নিয়ম আছে অথচ অকালেই সড়কে ঝরে যাচ্ছে প্রাণ! দেখেন, প্রায় প্রতিদিন মানুষের প্রাণ বেঘোরে চলে যায় অথচ এর জন্য কোনো শাস্তি হয়না। তাহলে সড়ক দুঘর্টনা কীভাবে কমবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি সড়ক দুঘর্টনার কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা এবং দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। এর সাথে আরও আছে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি ও চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও চালকদের শারীরিক মানসিক অসুস্থতা, মহাসড়কে স্বল্পগতির অবৈধ যানবাহন চলাচল, বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো আর সচেতনতার অভাব রয়েছে। যতদিন না এর আইন মানাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে ততদিন পরিস্থিতি খারাপের পথে যাবে।’

তবে এ নিয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে মামলা হলেও জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হয় না। যার কারণে অপরাধী অপরাধ করে পার পেয়ে যায় এবং বারবার অপরাধ করে। সেইসঙ্গে এইসকল দুঘর্টনার সঠিক চিত্র বিশ্লেষণও করে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সড়ক দুঘর্টনায় কতজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএমপির সিনিয়র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দুঘর্টনায় মামলা হলে সেসব সূত্র ধরে আমরা নিহত-আহতদের লিষ্ট করি। তারপর অবৈধ, ফিটনেসবিহীন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলে তার জন্য মামলা করি। কিন্তু কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘কোথাও বেপরোয়া গতির জন্য মামলা দেয়া হয় না। কিন্তু চালক কত স্পিডে গাড়ি চালায় তার রেগুলেটর ঢাকায় থাকলেও আমাদের নেই। ওই উন্নত প্রযুক্তি আমাদের হাতে এখনো আসেনি।’

একই বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই চট্টগ্রাম নগর কমিটির সদস্য সচিব শফিক আহমেদ সাজীব সিভয়েসকে বলেন, ‘অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা সড়কে দুর্ঘটনার মূল কারণ।’

এ বিষয়ে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ সিভয়েসকে বলেন, ‘গাড়ির অতিরিক্ত গতিসহ নানান কারণে সড়ক দুঘর্টনা ঘটে থাকে। এসকল ঘটনায় মামলা হলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি।’ এর বেশি কথা বলতে তিনি রাজি হননি।


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *