গুলিস্তানে বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ১৮

গুলিস্তানে বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ১৮

রাজধানীর গুলিস্তানের কাছে সিদ্দিকবাজারের এক ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ১৬ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ১১৭ জন। 

মঙ্গলবার (৭ মার্চ) দিবাগত রাত ২টা পর্যন্ত ঢাকার জেলা প্রশাসন মরদেহগুলো হস্তান্তর করে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার সুবীর কুমার দাশ বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। 

বিস্ফোরণে নিহতরা হলেন- মো. সুমন (২১), ইসহাক মৃধা (৩৫), মুনসুর হোসেন (৪০), মো. ইসমাইল (৪২), আল আমিন (২৩), রাহাত (১৮), মমিনুল ইসলাম (৩৮), নদী বেগম (৩৬), মাঈন উদ্দিন (৫০), নাজমুল হোসেন (২৫), ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), আকুতি বেগম (৭০), মো. ইদ্রিস (৬০), নুরুল ইসলাম ভূইয়া (৫৫), হৃদয় (২০), সম্রাট ও সিয়াম (১৮)। 

যে ১৬ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে তারা হলেন— মুনসুর, আলামিন, আবু বক্কর সিদ্দিক, নাজমুল হোসেন, রাহাত, ওবায়দুল হাসান, নুরুল ইসলাম, হৃদয়, মাইনুদ্দিন, মমিনুল, নদী বেগম, আকুতি বেগম, ইসমাইল হোসেন, ইছহাক মৃধা, সুমন ও আব্দুল হাকিম।

এদিকে হাসপাতাল থেকে দুটি মরদেহ স্বজনরা জোর করে নিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। 

এর আগে মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে গুলিস্তানের কাছে সিদ্দিকবাজারের নর্থ-সাউথ রোডে ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে।

যে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার তিনতলা পর্যন্ত পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে স্যানিটারি ও গৃহস্থালি সামগ্রীর বেশ কয়েকটি দোকান ছিল। বিস্ফোরণে ভবনটির দেয়াল ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ভেতরের জিনিসপত্র ছিটকে বাইরে পড়েছে। ভবনের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাশের কয়েকটি ভবনও। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে উদ্ধারকাজ স্থগিত রয়েছে।

পাশের সাকি প্লাজার চারটি ফ্লোরে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলিস্তান শাখা এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এসএমই সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। বিস্ফোরণে কাচ ভেঙে ব্যাংকের অফিস কক্ষগুলোর পর্দা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো এলাকা। দেয়াল ভেঙে এসে পড়ে রাস্তায়। বহু মানুষ উড়ে এসে রাস্তায় পড়েছেন। সড়কে থাকা বহু গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পার্শবর্তী ভবনগুলোও। ভেঙে পড়েছে অনেক ভবনের কাঁচ। বাসযাত্রী থেকে শুরু করে পথচারী পর্যন্ত আশপাশে থাকা সবাই হতাহত হয়েছেন। ঘটনার পর রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সসহ যে যেভাবে পেরেছেন আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েছেন।

আল আমিন নামে পাশের মার্কেটের এক কর্মী বলেন, হঠাৎ বিস্ফোরণের পর বের হয়ে দেখি রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন বহু মানুষ। ৮ জনকে আমি নিজে ভ্যানে উঠিয়ে মেডিকেলে পাঠিয়েছি। তারা সবাই মারা গেছেন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।

এছাড়া আরও বহু লোক আহত হয়ে পড়েছিলেন। যে যেভাবে পেরেছে তাদের মেডিকেলে পাঠিয়েছে। রাস্তায় থাকা সব গাড়ি, পথচারী, রিকশা, ভ্যান- সবকিছুই বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান আল আমিন।

বিস্ফোরণের ঘটনায় সদরঘাট থেকে সাভারগামী একটি বাস চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। ঘটনাস্থলে থাকা ওয়াহিদুজ্জামান নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাসটি সদরঘাট থেকে সাভার যাচ্ছিল। এটি বিস্ফোরণের সময় ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। বাসটির নাম সাভার পরিবহন। এর নম্বর ঢাকা মেট্রো গ ১৫-৪৩২৮। বাসটিতে ৪০-৫০ জন যাত্রী ছিলেন। ভেতরে থাকা প্রায় সবাই আহত হয়েছেন। একই সময় রাস্তার উল্টো পাশে যত গাড়ি ছিল সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান ওয়াহিদুজ্জামান। 

শ্যামপুরের কর্মস্থল থেকে সাভার পরিবহনের একটি বাসে বাড়ি যাচ্ছিলেন সাভারের বাসিন্দা আবুল কালাম। গুলিস্তানের একটু আগে হঠাৎ বিস্ফোরণ হলে বাসের ওপর এসে পড়ে ভবনের দেয়ালসহ বহু কনক্রিট ও ধাতব টুকরো। এতে আহত হন আবুল কালাম। ঢামেক হাসপাতলে চিকিৎসা নিতে এসে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন তিনি। 

প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে পরিবারের সাথে মোবাইলে কথা বলার সময় বারবার বলছিলেন ‘আল্লাহর রহমতে জীবিত ফিরে আসা’র কথা। তিনি বলেন, কী যে বিকট শব্দ হয়েছিল তখন। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি। কিছুই মনে করতে পারছি না তারপর কী হয়েছে। 

সুন্দরবন কুরিয়ার অফিসে কাজ করেন তোফাজ্জল ও আল আমিন। কাজ শেষে অফিস থেকে নিচে নামতেই আকস্মিক বিস্ফোরণ। এতে তারা দুজন উড়ে গিয়ে পড়েন রাস্তায়। এরপর তারা আর কিছুই বলতে পারেন না। তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ফিরিয়ে আনা হয় বিআরটিসি অফিসের সামনে একটি মার্কেটে। সেখানে কথা হয় তাদের সঙ্গে। আকস্মিক বিস্ফোরণের ঘটনায় বাকরুদ্ধ আল আমিন ও তোফাজ্জল কিছুই বলছিলেন না।

তবে তাদের উদ্ধারকারী এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, দুজনই ঘটনাস্থলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল। চারদিকে শুধু কান্নার আহাজারি। আল আমিন ও তোফাজ্জল আমার পূর্ব পরিচিত। তাই ওদের আগে উদ্ধার করি। ভ্যানে করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ড্রেসিং শেষে দোকানে নিয়ে আসি। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মালিক ঘটনাস্থলে আসছেন। তাদের কাছে আহত দুজনকে হস্তান্তর করা হবে।

মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে বিস্ফোরণের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ঘটনার পর থেকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ১১টি ইউনিট কাজ শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিন মনি শর্মা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, নর্থ সাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ে একটা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে। 

তিনি বলেন, সাত তলা যে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার নিচের দুটো তলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে স্যানিটারি সামগ্রী আর গৃহস্থালী সামগ্রীর বেশ কয়েকটি দোকান ছিল। বিস্ফোরণে দেয়াল ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ভেতরের জিনিসপত্র ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভবনের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসও।

ভয়াবহ বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এসময় তিনি বলেন, ঘটনাটি কোনো নাশকতা নাকি গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হয়েছে তা তদন্ত করে দেখছেন আমাদের বিশেষজ্ঞরা। কমিশনার বলেন, ‘অনেক সময় মিথেন গ্যাস, এসির গ্যাস বা পয়োঃগ্যাস জমে এমন বিস্ফোরণ হতে পারে। এখন এটা নাশকতা, নাকি দুর্ঘটনা তা আমাদের দায়িত্বরত বিশেষজ্ঞ দল তদন্ত শেষ করে বিস্তারিত বলতে পারবেন।’

তিনি জানান, ওই ভবনে যারা আটকে পড়েছিল সবাইকে উদ্ধার করা হয়েছে। হয়তো নিচে এখন দু’চারজন আটকে থাকতে পারেন। তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‌্যাবের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। চিকিৎসক ও নার্সদের কোনো সংকট নেই। চিকিৎসায় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *