চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে সরকারি জরিপে ‘খাল’ না থাকার সুযোগ নিয়ে জেলেদের সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার সরকারি একটি খাল দখল করে নিচ্ছে জিরি সুবেদার নামে একটি শিপ ইয়ার্ড। এছাড়াও একই খালের মুখে কাটার জন্য আনা পুরাতন জাহাজ রেখে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে সীকো স্টিল নামের আরেকটি ইয়ার্ড। এনিয়ে ভুক্তভোগী জেলেরা দ্বারস্থ হয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের। দিয়েছেন লিখিত অভিযোগও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তথ্য গোপন করে সরকারি খালকে সমতল ভূমি দেখিয়ে ইজারা নিয়েছে জিরি সুবেদার শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। ইজারার পর জরিপে সমতল ভূমি থাকার সুযোগ নিয়ে ঐ খালের বিভিন্ন অংশ দখল করে নিচ্ছে তারা। ফলে এই পথে সাগরে যাতায়াত করা ৩ শতাধিক জেলের যাতায়াত বন্ধের উপক্রম হয়েছে। অন্যদিকে খালের পাশ্ববর্তী সীকো স্টিল নামের অন্য একটি ইয়ার্ড কাটার জন্য আনা পুরাতন একটি জাহাজ রাখায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে খালের মুখ।
ভুক্তভোগী জেলেরা এসবের প্রতিকার চেয়ে ইউএনও, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও প্রেস ক্লাবে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ইউএনও ও সহকারী কমিশনার। তারা খাল দখল মুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবুও খালটি নিজেদের জায়গার মধ্যে অবস্থিত দাবি করে দখলের কথা অস্বীকার করেছেন জিরি সুবেদার কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোনাইছড়ি ইউনিয়নের সরকারি খালের পার্শ্বস্থ সরকারি সমুদ্র সিকস্তি ভূমি ইজারা নিয়ে সেখানে শিপব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপন করেছে জিরি সুবেদার ষ্টিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ড নামক একটি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রতিবছর লিজ নবায়নের মাধ্যমে সাগর উপকূলীয় সরকারি ভূমিতে জাহাজ কেটে আসলেও সম্প্রতি তারা ইয়ার্ডের পাশে অবস্থিত সোনাইছড়ি খালের পাশে বিভিন্ন রকম লোহার পাইপ ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে দখল করেছে। এতে খালের আয়তন ক্রমশ ছোট হয়ে আসায় ঐ খাল দিয়ে সাগরে মাছ শিকারে যেতে পারছে না স্থানীয় মৎস্যজীবীরা। তারা বারবার এর প্রতিকার জানালেও জিরি সুবেদার কর্তৃপক্ষ কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে জেলেদের সাগরে যাবার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে এখনো। তাছাড়া জেলেরা প্রতিবাদ করলে সন্ত্রাসী দিয়ে তাদের মারধর করে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়। ফলে জেলেরা এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করে দখল বন্ধ করতে আর্জি জানিয়েছে।
এদিকে অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, জিরি সুবেদার ষ্টিল শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ সোনাইছড়ি খালের পাশে লোহা ও সিমেন্টের বিভিন্ন পিলার স্থাপন ও দেয়াল নির্মাণ করে জায়গা নিজেদের দখলে নিয়েছে। এর ফলে ৫০ ফুটের খালটি এখন অনেক ছোট হয়ে আসছে। এতে জেলেদের সাগরে যাওয়া ব্যাহত হচ্ছে।
ঐ এলাকার জেলে শিবু জলদাশ ও লিটন দাশ অভিযোগ করে বলেন, শত বছর ধরে বংশানুক্রমে আমরা সোনাইছড়ি খাল হয়ে মাছ শিকার করছি। এখন ঐ সরকারি খালসহ আশপাশের জায়গা জিরি সুবেদার ষ্টিলকে ভূমি অফিস ইজারা দিয়েছে। আবার প্রতিবছর ইজারা নবায়ন করলেও এটি যে খাল তা খতিয়ানে কখনোই তুলেনি ভূমি কর্মকর্তারা। এই সুযোগে খালের তথ্য গোপন করে খালসহ পুরো জায়গাটিকে নিজেদের মতো দখলে রেখেছে জিরি সুবেদার ষ্টিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। ভূমি কর্মকর্তারা ঐ সুবিশাল খালটি বারবার দেখে আসলেও তা ইজারা থেকে কখনোই বাদ দেয়নি। অন্যদিকে সিকো স্টিল জাহাজ রেখে খালের মুখ পুরোটাই বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারছে না। এই খাল দখল মুক্ত করা না গেলে তা জেলেদের ভবিষ্যত অনিশ্চিতায় নিয়ে যাবে বলে তারা মনে করেন।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে জিরি সুবেদার ষ্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাঈম আহমেদ বলেন, ৫০ ফিট আয়তনের ঐ খালটি আমাদের লিজকৃত জায়গার মধ্যে। কিন্তু আমরা খাল ছেড়ে দিয়েই সীমানা দিয়েছি। তাই জেলেদের আমাদের বিষয়ে কোন অভিযোগ থাকার কথা না। জেলেদের অভিযোগ পাশের ইয়ার্ড সীকো ষ্টিলের বিরুদ্ধে।
সীকো শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিক আলহাজ্ব কামাল উদ্দিন বলেন, আমরা কোন খাল দখল করিনি। জিরি সুপাদার শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড খাল দখল করে দেওয়াল দিচ্ছে। ভাটার টানে আমাদের একটি জাহাজ খালের মুখে চলে গেছে। আমরা অতিদ্রুত এটি কেটে সরিয়ে নিব।
সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বলেন, অভিযোগ পেয়ে আমরা সরেজমিন গিয়ে দেখেছি। জিরি সুবেদার কর্তৃপক্ষকে যে জায়গা সরকার ইজারা দিয়েছিল খালটি সে জায়গার মধ্যেই অবস্থিত। খালটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি। কিন্তু আমাদের সিটে খাল উল্লেখ না থাকায় খালটির জায়গাও তাদের লিজ দেয়া হয়েছিলো। তবে খাল দখল করা যাবে না। তারা খালের পাশে লোহার পাইপ ও অন্য জিনিস স্থাপন করা ঠিক হয়নি। তাই সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। আর যেহেতু জিরি সুবেদারের অনেকটা জায়গা খালের মধ্যে পড়ে গেছে তাই জেলেদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য পাশের সীকো ষ্টিলকে খাল মুখে ১০ ফিট জায়গা ছাড়তে বলেছি।
ইউএনও শাহাদাত হোসেন বলেন, খাল জরিপে না থাকলেও এটিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবেনা। খালের উভয় পাশের দুই ইয়ার্ডকে খালের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মফিদুল আলম বলেন, সরকারি খাল দখলের বিষয়ে আমরা অবগত ছিলাম না। আমরা খোঁজ নিয়ে প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।