সীতাকুণ্ডে গৃহবধূকে গণধর্ষন ও হত্যা মালার রহস্য উদঘাটন
এম কে মনির,সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম
সীতাকুণ্ডে স্বামীর চক্রান্তে স্ত্রীকে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্তে বিস্ময়কর তথ্য ওঠে এসেছে।দীর্ঘ ২ মাসের এই তদন্তে নিশ্চিতভাবে পুলিশের সফলতা বহন করছে বলে দাবী সীতাকুণ্ড মডেল থানা পুলিশের।চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়ের পরিত্যক্ত কলোনির এক ডোবা থেকে এক অজ্ঞাত মহিলার লাশ উদ্ধার করে সীতাকুন্ড মডেল থানা পুলিশ । কিন্তু মহিলাটি কে তা যেমন সনাক্ত করা যাচ্ছিলনা তেমনি কোন ক্লুও পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে সীতাকুণ্ড থানার পুলিশ ও সিআইডি এ নিয়ে তদন্তে নেমে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে রীমার পরিচয় উদঘাটন করতে সক্ষম হলে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (ইন্টিলিজেন্স) সুমন বণিক এ মামলার তদন্ত শুরু করেন । সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়ের পরিত্যক্ত কলোনি থেকে উদ্ধারকৃত লাশটি প্রকৃতপক্ষে একজন ডিভোর্সি নারীর। তাকে পরিকল্পিতভাবে ঐ কলোনিতে নিয়ে সাবেক স্বামীসহ তিন দুর্ধর্ষ খুনী গণধর্ষণ শেষে হত্যা করেছিল।
রবিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধীতে এসব তথ্য দিয়েছেন ঐ ঘটনায় জড়িত তিন খুনী। এর আগে গত শনিবার হত্যাকান্ডের প্রধান আসামি মাহমুদুল্লাহ প্রকাশ মামুনকে ভোলা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় ঘটনায় জড়িত অন্য দুই আসামিকেও। আর এর মধ্য দিয়ে অনেকটা ক্লুবিহীন একটি হত্যার রহস্য উন্মোচিত হলো।
সীতাকুণ্ড থানা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলকনটওয়াইটিলা গ্রামের মোঃআমির হামজার মেয়ে রিমা বেগম (২৫) এর সাথে কুমিল্লা ব্রাম্মণপাড়া থানার সাহেবাবাদ গ্রামের সাদন মিয়ার ছেলে মো. রাসেল (৩৫) এর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। দীর্ঘ ৭ বছর সংসারের ঘ্লানি টানার পর রিমার জীবনে নেমে আসে দূর্বীষহ দুঃখ কষ্ট।একসময় তার জীবনে বিচ্ছেদের আগমন ঘটে। এ বিচ্ছেদ নিয়ে রিমার উপর ক্ষুব্ধ ছিলো রাসেল। এদিকে রাসেলের সাথে বিচ্ছেদের পর রিমা চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানাধীন আমিন কলোনির বেলতলায় বসবাস শুরু করে।কাজ নেয় একটি গার্মেন্টসে।এরপর সুখের খোঁজে নুর হোসেন নামক আরেকজনের সাথে ঘর বাঁধেন রিমা। এই সূত্রে নুর হোসেনের পরিচিত ভোলা সদর থানার ধনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের কানাইনগর গ্রামের ইউনুস মাতব্বরের ছেলে মাহমুদুল্লাহ প্রকাশ ভাগিনা মামুন (৩৪) এর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে রিমার। তাদের গভীর সখ্যতার কারণে রীমা গত ঈদে ভোলায় অবস্থিত মামুনের বাড়িতেও বেড়াতে যায়। এদিকে রীমার সাথে বিচ্ছেদ হলেও সাবেক স্বামী রাসেল রীমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সে মামুনের সাথে রীমার বন্ধুত্বের কথা জেনে তাকে টাকাসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য দেয় এবং রীমাকে এক রাতে তার কাছে নিয়ে আসার জন্য রাজি করায়। এ উদ্দেশ্যে তারা আগে থেকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়ের পরিত্যক্ত একটি কলোনিকে বেছে নেয়।
গত ৫ জানুয়ারী রাতে মামুন কৌশলে রীমাকে ঐ কলোনীতে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষান ছিল তার সাবেক স্বামী রাসেল ও তার বন্ধু নোয়াখালী সদর থানার বুদ্ধিনগর চৌরাস্তা আন্ডারচর গ্রামের মো. রফিকের ছেলে মো. জামাল (৩০)। এখানে রাসেলসহ তিনজনই তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।রীমা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে তাছাড়া এই গণধর্ষণের ঘটনা সে সবাইকে জানাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে বলে জানায়। এ নিয়ে রাসেলের সাথে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে তারা তিনজন রীমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।ঘটনার একপর্যায়ে রাসেল তাকে মাটিতে শুইয়ে পা চেপে ধরে এবং মামুন তার মাথা আর জামাল গলা চেপে ধরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশটি ডোবায় ফেলে দেয়।
এদিকে পরদিন ৬ জানুয়ারি ডোবাতে একটি অজ্ঞাত লাশের খবর পেয়ে পুলিশ সেটি উদ্ধার করে। এ ঘটনায় মামলা (নং ১২তাং ০৬.০১.২০২০ইং) দায়ের করা হয়।। সীতাকুণ্ড থানার পুলিশ ও সিআইডি এ নিয়ে তদন্তে নেমে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে রীমার পরিচয় উদঘাটন করতে সক্ষম হলে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (ইন্টিলিজেন্স) সুমন বণিক এ মামলার তদন্ত শুরু করেন। তিনি থানার এডিশনাল এসপি শম্পা রানী সাহা ও ওসি মো. ফিরোজ হোসেন মোল্লার সার্বক্ষণিক পরামর্শ অনুযায়ী আসামিদের শনাক্ত করার কাজ শুরু করেন। রীমার আগের জীবন ও মৃত্যুর আগের অবস্থান জানতে ছদ্মবেশে চট্টগ্রামের আমিন কলোনিতে বারবার অবস্থান করেন। সেখানে মামুনের সাথে রীমার সর্বশেষ ভালো সম্পর্কের বিষয়ে অবগত হন। পরে তার বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করে এ ঘটনায় তার জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হলে তাকে গ্রেপ্তারে গত শুক্রবার ভোলায় অভিযান চালান। সেখান থেকে মামুনকে গ্রেপ্তার করে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার কাছে থাকা বিভিন্ন প্রমাণ উপস্থাপন করলে মামুন ঘটনার কথা স্বীকার করে। এ ঘটনায় জড়িত রাসেল ও জামালের তথ্য দিয়ে বিস্তারিত খুলে বলে। শনিবার রাতে চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করেন সুমন বণিক। এরপর রবিবার তাদেরকে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত চট্টগ্রাম ১ এর শহীদুল্লাহ কায়সারের আদালতে নিয়ে গেলে সন্ধ্যায় সেখানে মামুনসহ তিনজনই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। তারা জানায় ধর্ষণের কথা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখানোয় রীমাকে হত্যা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. ফিরোজ হোসেন মোল্লা বলেন, এটি একটি ক্লুলেস দুর্ধর্ষ গণধর্ষণ ও হত্যা মামলা। আমরা বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলাম বলে সফলতা এসেছে।
সীতাকুণ্ড থানা সার্কেলের এডিশনাল এসপি শম্পা রানী সাহা বলেন, প্রথমে মেয়েটির পরিচয়ও পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু এমন একটি মামলাও আমরা টিমওয়ার্কের মাধ্যমে সফলতা এনেছি। প্রথম থেকেই আমি এটির পেছনে সময় দিয়েছি।