না না শিরোনাম দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। এরাই সীতাকুণ্ডের এক একজন প্রতিচ্ছবি। যদিও আপনাদের দৃষ্টিতে ভিন্ন হতে পারে। কারণ আমার দৃষ্টিটা কিছুটা ক্ষীণ। তারপরও ইন্টারনেটের এই ধূম্রজালে কিছু কিছু চরিত্র মঞ্চের মত আবিষ্ট হয়। আমি তাদের কথা বলছি। আজ থাকল দ্বিতীয় পর্ব….
শীতের পাতা ঝরা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিরুপাক্ষ পাহাড়টায় রঙ ধরেছে। রাতের আলসে ভেঙ্গে সূর্য উঠতে উঠতে জানান দিল আজ একুশে ফেব্রুয়ারি । পাহাড়টার ঠিক কিছু দূর আগে কৃষ্ণচূড়ায় ঢেকে আছে সীতাকুণ্ড ডিগ্রী কলেজ। এখানেই এই মফস্বল থানাটির কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম“ ; ফজরের আজানটা দেবার ঠিক পরেই দেখল বাবা নামাজ পড়ছে। বাবার সাথে নামাজের কাতারে দাড়িয়ে প্রশান্তির প্রার্থনা শেষ করে সাদা শার্ট সাদা প্যান্ট পরে খালি পায়ে দে দৌড় । হাঁপাতে হাঁপাতে সীতাকুণ্ড সরকারী আদর্শ বিদ্যালয়ের মাঠে। ওখানে রিক্সা ভ্যান আসবে। ভ্যানের পেছনে মাইক্রোফোন লাগাতে হবে। ফুলের তোড়াটার উপরে লিখতে হবে বড় বড় করে স্কুলের নাম, সব ছাত্ররা আসার পর লাইন রেডি করতে হবে। বুক পকেটে লাগাতে হবে কালো ব্যাজ। ইস্ কালো ব্যাজ গুলো কি কাটা হয়েছে? দেখতে হবে কারো পায়ে স্যান্ডেল আছে কিনা। তারপর ধীরে ধীরে চলতে থাকবে শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে কাফেলা। আর এ সব আয়োজনের অনেকটা নেতৃত্বে কে জানেন ? সে হল সাইফুর রহমান শাকিল। কিশোর ছেলে কিন্তু এ বয়সে সীতাকুণ্ডের এমন কোন সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই যেখানে সে নেই। উপস্থাপনা যে কত শৈল্পিক হতে পারে কিশোরটি দেখিয়েছিল সেই স্কুল বয়সে। কিশোর থেকে বড় হয়ে যুবক হল আর তার সাথে সাথে বড় হল নিজের তৈরি শুদ্ধ সংগঠন মাতৃভূমি সামাজিক সংগঠন। না এবার একটু নিজের জন্য ভাবতে হবে। এগুলো করলেতো আর পেট চলবেনা । চলে এলো ঢাকায়। অনেকখানি পরিশ্রম,নিষ্ঠা আর নিজের যোগ্যতায় সেই কিশোর ছেলেটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম টেলিভিশন ক্যামেরা সাংবাদিক। কি বুঝতে পারছেন? রাষ্ট্রীয় ভাবে এমন কোন সাংবাদিক বা জনপ্রতিনিধি নেই যে এই সীতাকুণ্ডের মেধাটাকে চিনেনা। কারণ তার অদম্য সাহস।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তার আছে, আছে আর পাঁচ জন প্রথম সারির সাংবাদিকের মত বিলাসী জীবন যাপন করার সাধ্য, সন্তান,সহধর্মিণী নিয়ে একটা নির্ঝঞ্ঝাট দিন সে কাটাতে পারতো। কি দরকার ছিল সীতাকুণ্ডের জন্য করার। না সে সেটা করেনি ঝাঁপিয়ে পরেছে সীতাকুণ্ডে, ঢাকায়। মহামারী তো শুরু হয়ে গেল। কি হবে সাধারণ মানুষের ! তাই শাকিল চেষ্টা করল সাধারণ মানুষকে যাতে না-খেয়ে থাকতে না-হয়, … কেউ যাতে অভুক্ত না-থাকে, অভাবের তাড়নায় কেউ যেন বলতে না পারে আমার ক্ষুধা লেগেছে ! নিজের সমস্ত উপার্জন ঢেলে দিল অসহায় মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য। সারাদিন ক্যামেরা নিয়ে দৌড় পরিশ্রমের পর রাতে এসে খাবার বানাতে লাগল তার দেবী তুল্য স্ত্রীর সঙ্গে আর সে খাবার গুলোকে প্যাকেটে ভরে নিয়ে বয়ে বেড়াতে লাগল ঢাকা শহরের অলি গলি। ওদিকে সীতাকুণ্ডের জন্য নিজের সমস্ত দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলো তার সংগঠন।
আমরা যখন সময় টিভিতে অপেক্ষার কাউন্ট ডাউন করি কত হল মৃত্যুর স্কোর, তখন সাইফুর রহমান শাকিল কাউন্ট ডাউন করে আজ রাতে কতজন অনাহারীকে এক মুঠো ভাত তুলে দিতে পারবে? কপালে হয়ত কিছুটা চিন্তার ভাঁজ। আমি আপনি যখন হাপিত্তাসের গল্প শোনাই ফেসবুকে; সে তখন বুকের ভেতর জ্বলন্ত আশার মশাল জ্বেলে নামে রাজ পথে। সোডিয়াম লাইটের কাছ ঘেঁষে হয়ত তুলে দিচ্ছে নাম নাজানা কোন বৃদ্ধার হাতে খাবার, যাকে হয়তো গতরাতে ফেলে গিয়েছে কোন পাষন্ড সন্তান। বৃদ্ধার পরিতৃপ্তির খাওয়া দেখে সাইফুর রহমান শাকিলের চশমাটা ঝাপসা হয়ে আসে, ডান পাশের চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরে । না না কান্না না , শাকিলরা কান্না করতে জানেনা………. বুঝতে হবে ছেলেটি সীতাকুন্ডের দামাল করোনা যোদ্ধা।
এ দিকে আরেকজন দামাল যোদ্ধার কথা বলছি .. মাঘ মাস এসে গেল। সীতাকুন্ডের প্রকৃতিটা এ সময়টা বড় অস্থির থাকে যেন সদ্য যৌবনে পা দেয়া কোন কিশোরী। সদা চঞ্চল। আর এ অঞ্চলের স্কুল কলেজ গুলোতে চলতে থাকে স্বরস্বতী পূজোর প্রস্তুতি। স্বভাবতই সীতাকুন্ড সরকারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মের শিক্ষক আমরা যাকে পন্ডিত স্যার নামে ডাকি; তিনি সাদা ধুতি আর এক কাপড়ের পাঞ্জাবী পরে একবার এদিক আর একবার ওদিকে। কি ভাবে যে কি করি! শিপলুটা পড়ালেখায় ভালো কিন্তু এত বেশি শান্ত! পারবেতো এ যাত্রায় পূজোটা সাকসেস করতে? বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলতো এনেছে দেখছি, কিন্তু অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ,যবের শীষ এগুলোতো এলনা, পূজো কবে শুরু করবো। এই বেটা আছে শুধু বিকালে কি করে সঙ্গীত অনুষ্ঠান হবে সে নিয়ে চিন্তা। দুপুরে নাকি আবার সবাইরে সে খাওয়াবে খিচুড়ি। আরে বেটা তুই এখনো দোয়াত-কলম আনতে পারলিনা আর তুই দুপুরে খাওয়াবি। গজ গজ করতে করতে ছটফট করছে পন্ডিত স্যার। ওদিকে প্রধান শিক্ষক নজির স্যার খুব শান্ত ভাবে এসে দাঁড়িয়েছে পন্ডিত স্যারের পাশে।
জিজ্ঞাসা করল কি পন্ডিত এত চিন্তা কেন?
আর বলবেননা শিপলুর উপর এত দায়িত্ব দিয়েতো বড় ফ্যাসাদে পরা গেল। ন বুঝির হিতে আবার ডুবাইবোনি কন।
নজির স্যার বলল ও শিপলুর কথা বলছেন? আপনি চিন্তা করবেননা পন্ডিত। ও ঠিকিই সব গুছিয়ে নেবে। শান্ত হলে কি হবে খুবি কাজ পাগল ছেলে, আপনি ঠান্ডা মাথায় বসুন , পূজোর আয়োজন করুন।
শুক্লা পঞ্চমী তিথি শুরু হয়ে গেল…পন্ডিত স্যার দেখলেন খুব অল্প সময়ে শিপলু সব ব্যবস্থা করে নিল। আবার দুপুরে ছাত্র আর দরিদ্রদের জন্য খিচুড়ি। বিকালে চমকপ্রদ অনুষ্ঠান মালার ভাঁজে ভাঁজে উঠে আসল চমক। পন্ডিত স্যার অবাক হলেন। এ হল শিপলু।
পশ্চিম পাড়া থেকে শুরু করে সীতাকুন্ডের আনাচে কানাচে যার শান্ত পথচলা। ধীরে ধীরে শাকিল সহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে শুরু করল মাতৃভুমি সামাজিক সংগঠন। সীতাকুন্ডবাসী একটু চমকে গেল উচ্ছ্বাসপূর্ন বৈশাখী মেলা দেখে। ওই শান্ত ছেলেটিই এঁকে দিল আর একটা পদচিহ্ন। আপনি কোন বিষয়ে বিরক্ত অথবা কোন সমস্যায় পড়েছেন? দেখবেন একটা ফর্সা সুন্দর শান্ত দেবতুল্য মানুষ বসে আছে নামারবাজার রাস্তাটার ঠিক উল্টোদিকে একটা বড় দোকানে। গিয়ে বলবেন আমি কিছু কিনবোনা শুধু একটু কথা বলব। দেখবেন মনটা শান্ত হয়ে গেছে।
সদা ব্যস্ত ছেলেটি দেখল করোনার আকাল পড়েছে সীতাকুন্ডে। মধ্যবিত্তদের পেটে আগুন জ্বলছে। ঢাকা , চট্রগ্রাম ভেদ করে ঢুকে পড়েছে মহামারী সীতাকুন্ডের মূল শহরে। পাতার মর্মরে একি অশনি সংকেত। সে দেখল রাস্তা দিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোর হাসি হাসি মুখের আড়ালে চাপা পড়েছে অভাব। এই ভেতরের কথা গুলো উপলব্ধি করল। মাথায় এল এরা তো কিছুই বলতে পারছেনা। কিভাবে এদের সাহায্য করা যায়। হায়রে মধ্যবিত্ত পেটে ক্ষুধা মুখে হাসি। তখন আর কিছু চিন্তা না করে শিপলু আর তার টিম মাতৃভুমি সামাজিক সংগঠন
মুখে মাস্ক পরে মৃত্যু কে উপেক্ষা করে দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দিল খাবার। কিন্তু এত অর্থ কোথা থেকে আসবে ? এত গুলো মানুষের ঘরে কি করে ঘরের বাজার পৌঁছে যাবে? কিন্তু সে আর মাতৃভূমি পরম মমতায় সমস্ত বাধা ভেদ করে ক্ষুধার যন্ত্রনা মেটাতে থাকল। একদিন হলকি একজন শিক্ষক লজ্জায় বলতে পারছিলনা ক্ষুধার কথা। শিপলু বুঝে নিল, বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে পৌঁছে গেল তার দুয়ারে বলল এ কথা কেউ জানবেনা শুধু আমি ছাড়া। আপনি আমায় ক্ষমা করবেন স্যার। আমরা আপনাকে কিছুই দিতে পারিনি। শুধু এটুকু দিলাম আমাদের উপহার। স্যারের চোখের কোনায় হালকা জল। শিপলু জানে এ জল ভালোবাসার জল। শিপলু দাশ একজন করোনা যোদ্ধা। স্যালুট আপনাকে।
জানেন শিপলু নামের অর্থ কি? শিপলু নামের অর্থ “মনযোগী”।
আমার ভার্চুয়াল চোখে দেখা সীতাকুণ্ডের করোনা যুদ্ধের দামাল যোদ্ধাদের গল্প এখনও শেষ হয়নি, চলবে…….
বন্ধু তুহিন
শিক্ষক
সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা.
থিয়েটার কর্মী, ইউটিউবার.
২৯.০৬.২০২০
হাতির-ঝিল,ঢাকা।