সীতাকুণ্ড বার্তাঃ
অলিউর রহমান। ২০০৫ সালে সীতাকুণ্ডের ইউএনও’র গাড়িচালক হিসাবে যোগ দেন। এরপর ইউএনও কার্যালয়, এসিল্যান্ড অফিস ও উপজেলা পরিষদকে আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ বানিয়ে নিজে বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক৷
পেশায় সরকারি গাড়িচালক এই অলিউর রহমানের নিজেরই রয়েছে একাধিক প্রাইভেট কার, পিকআপ ও ড্রাম ট্রাক। ইউএনও এর গাড়িচালক হিসেবে সীতাকুণ্ডে যোগদানের পর ছলে বলে কৌশলে ২০১৮ সালে এলপিআর এ যাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য কোথাও বদলি হননি অলিউর। রবং অবসরের পরেও অল্পটাকা বেতনে এখন পর্যন্ত ইউএনও’র গাড়িচালকের আসনে বসে আছেন তিনি ৷ আর এই জিপ চালকের আসনে বসে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে বিপুল অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠার পরেও কেউ প্রকাশ্য অলিউরের বিরুদ্ধে টু’ শব্দটি করেনি। অনেক বড় কর্তার আশীর্বাদ পুষ্ট এই চালকের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এখন ভীত-সন্ত্রস্ত থাকেন বলে বাংলাদেশ বুলেটিনের কাছে স্বীকার করেছেন৷
বাংলাদেশ বুলেটিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা প্রধানদের গাড়িচালক হওয়ার অনেকটা ক্ষমতার কেন্দ্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে অলিউর রহমান৷ দীর্ঘদিন একই স্থানে চাকুরির সুবাদে সীতাকুন্ড উপজেলার আপাদমস্তক তার নখদর্পনে। এছাড়া সীতাকুন্ডে নিজের শিকড়কে আরো শক্তিশালী করতে উপজেলার পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ড সংলগ্ন কোটি টাকার জমি কেনেন তিনি। তবে এই জমি কেনার কথা স্বীকার করলেও জমির পরিমাণ ও দর অনেক কম বলে দাবি করেছে অলিউর রহমান ৷ একই সাথে তিনি আরো দাবি করে বলেন, ‘সেই জমি কিনে দেয়ার কাজে সার্বিক ভূমিকা রেখেন খোদ ইউএনও মিল্টন রায়। ড্রাইভারের জমি কেনার বিষয়টি ইউএনও (মিল্টন রায়) অবগত আছেন বলে স্বীকার করলেও সার্বিক লেনদেন বা অন্য কিছুতেই তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে দাবি করছেন।’
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে উপজেলার ভিতর সরকারি জায়গায় অলিউর নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি রাখার গ্যারেজ নির্মাণ করেছে। টিন দিয়ে স্থায়ীভাবে নির্মিত গ্যারেজটি ইউএনওর বাসার পেছনে অবস্থিত। যেখানে অলিউরের ব্যক্তিগত দুটি প্রাইভেট কার ও একটি পিকআপ রাখা হয়। এছাড়াও সীতাকুণ্ড উপজেলায় ইট, বালি ভরাট ও সরবরাহের কাজে তার কয়েকটি ড্রাম ট্রাক রয়েছে বলে জানা গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এসব গাড়ির চলাচল নির্বিঘ্ন করতে অনেক সময় সরকারি স্টিকার লাগিয়ে রাখা হয়৷ এই করোনার লকডাউনের সময় সরকারি কাজের নামে তার মিকআপ ট্রাকগুলো মালামাল পরিবহন করছে। অন্যদিকে নিজের একাধিক গাড়ি আছে বলে স্বীকার করলেও সরকারি স্টিকার লাগানোর অভিযোগ অস্বীকার করে অলিউর বলেন, আমার কোন গাড়িতে সরকারি স্টিকার নাই। তবে আমার মিনিট্রাক যেহেতু সরকারি ত্রাণ বিতরণ পরিবহনের অনুমতি আছে তাই সেটাতে মুভমেন্ট পাশ লাগানো আছে। এই বিষয়ে ইউএনও মিল্টন রায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি এমন কোন অনুমতি পত্র দেওয়া হয়নি বলে জানান।
অভিযোগ আছে সীতাকুণ্ডে যোগদানের পর তিনি সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নিজের জন্য বরাদ্ধকৃত কোয়াটারে না উঠে অলিউর উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মাস্টার রোলে কর্মরত মোহাম্মদ দিদারুল আলম মামুনের নামে বাসা বরাদ্ধ দেখিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। এতে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ ঘড়ভাড়া বাবদ পরিশোধ করার কথা থাকলেও তিনি প্রতিমাসে সেই ঘড়ভাড়ার ৯৪৬৬ টাকা তুলে নিয়েছেন। তবে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অফিস সহায়ক মামুনের নামে বরাদ্ধ নেওয়া রুমের ভাড়া দুই হাজার টাকা পরিশোধ করতেন অলি। এতে অবসরের আগ পর্যন্ত একযুগেরও বেশি সময় ধরে চলা অনিয়মের কারণে লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
সীতাকুণ্ড উপজেলায় যোগদানের পর সরকারি রাজস্ব ফাঁকির পাশাপাশি ঘুষ বাণিজ্য ও নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন অলিউর রহমান। তার একক আধিপত্যের কারণে জিম্মি হয়ে পড়েন উপজেলার অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। অভিযোগ আছে তিনি কোন সরকারি কর্মকর্তাকেই কেয়ার করেনা।
দায়িত্বের বাইরে অনেক কিছুতেই হস্তক্ষেপ করে। বিশেষ করে এসি ল্যান্ড অফিসে ভূমিসংক্রান্ত কাজ করিয়ে নিতে কন্ট্রাকের কাজও করছেন অলিউর। আর নিজ অফিসের কর্তাদের জিম্মি করতে প্রশাসনিক অনেক গোপনীয় তথ্য ও নথিপত্র ফাঁস করে।
সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড ও শিল্প-কলকারখানা থেকে ইউএনও’র নামে মাসোহারা আদায়ে সিদ্ধহস্ত অলিউর সেই টাকা উপর মহল অব্দি পৌঁছে দেওয়ার বিশ্বস্ত মাধ্যম হয়ে উঠায় উপজেলা প্রশাসন তার বিরুদ্ধে আজ অব্দি কোন ব্যবস্থা নেয়নি৷ নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলার এক কর্মকর্তা বলেন, অলিউর বড় সাহেবদের টাকার ব্যাংক ৷ তার সব স্যারেরাই তাকে অনেক ছাড় দেয়।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাসিন্দা অলিউর রহমানের দুই ছেলে এক মেয়ে। তাদের মধ্যে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার টিন সার্টিফিকেটে সব সম্পদের হিসেব দেওয়া আছে৷ আমাকে ইউএনও স্যার নিজেই অনুরোধ করে তার গাড়ি চালাতে সীতাকুণ্ডে রেখেছেন ৷ অফিসে কর্মকর্তা কর্মচারীদের অন্যায় দেখলে তিনি প্রতিবাদ করেন তাই সবাই তার বিরুদ্ধে নালিস করে বলে জানান তিনি৷
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, ড্রাইভার অলিউর রহমানের অপকর্মের বিষয়টি জেলা প্রশাসক নিজেই অবগত ৷ ড্রাইভারের অদ্ধৌত্ত্বপূর্ণ আচরণে খোদ সীতাকুণ্ডের ইউএনও নিজেও বিরক্ত ৷ তবে রহস্যজনক কারণে সবাই অলিউরকে লালন করেই চলছে।
সূত্রঃ বাংলাদেশ বুলেটিন