মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের দুর্নীতির মূল সহযোগী স্ত্রী চুমকি কারণের কোনো হদিস দিতে পারছেন না কেউ। ২০২০ সালে প্রদীপ গ্রেফতার হওয়ার পরপরই তার স্ত্রী আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ বলছেন, চুমকি চট্টগ্রামেরই কোথাও ‘সেফ হাউসে’ লুকিয়ে আছেন। চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটায় প্রদীপের ছয় তলা বাড়ি লক্ষ্মীকুঞ্জে সন্তান নিয়ে থাকতেন তিনি। সেই বাড়িতেও চুমকি নেই স্বামী গ্রেফতারের পর থেকেই। তবে বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, চুমকি বহু আগেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছেন। ভারতের আগরতলা, কলকাতার বারাসাত ও গৌহাটিতে প্রদীপ-চুমকি দম্পতির নিজস্ব বাড়ি রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত।
জানা গেছে, প্রদীপের মামলা সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখাশোনা করছেন তার ভাই চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সাবেক হেডক্লার্ক দিলীপ কুমার দাশ। প্রদীপের পক্ষের আইনজীবীদের মোটা অংকের সম্মানীসহ অন্য খরচগুলো দিলীপের হাত দিয়েই যাচ্ছে। সেই টাকা তিনি কোত্থেকে পাচ্ছেন, সে ব্যাপারে অবশ্য কিছু জানা যায়নি।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই সংঘটিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে গত সোমবার (৩১ জানুয়ারি)। ওই রায়ে টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার ও বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে প্রায় চার কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে ২০২০ সালের ২৩ আগস্টে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ সহকারী পরিচালক মোঃ রিয়াজ উদ্দিন একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, স্বামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরপূর্বক একে অপরের সহযোগিতায় ভোগদখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন চুমকি কারণ।
২০২০ সালে ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সিনিয়র স্পেশাল দায়রা জজ আশফাকুর রহমান ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর নামে থাকা সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ দেন।
প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অভিযোগ ওঠায় ২০১৮ সালের জুনের মাঝামাঝি থেকে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করে চট্টগ্রামের দুদক। এরপর ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রীকে সম্পদের হিসাব জমা দিতে বলা হলেও চুমকি সেটা জমা দেন ২০১৯ সালের ১২ মে তারিখে।
দুদকের দেয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় ছয়তলা বাড়ি, ষোলশহরে বাড়ি, ৪৫ ভরি সোনা, একটি ব্যক্তিগত গাড়ি, একটি মাইক্রোবাস, ব্যাংক হিসাব এবং কক্সবাজারে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে চুমকির নামে। তার চার কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫১ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিপরীতে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় দুই কোটি ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৪ টাকা। ফলে দুই কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। এছাড়া চুমকি নিজেকে মৎস্য ব্যবসায়ী দাবি করলেও এ ব্যবসায়ের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় ছয়তলা বাড়ির বিষয়ে চুমকি ওই সময় দুদককে জানান, ২০১৩ সালে বাড়িটি তার বাবা তাকে দান করেছেন। যদিও চুমকির অন্যান্য ভাই ও বোনদের তার বাবা কোনো সম্পত্তি দান করেননি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৬ সালে শ্বশুরের নামে বাড়ির জমি কেনেন প্রদীপ। এরপর ছয়তলা বহুতল ভবন গড়ে তোলেন।
চুমকির নামে যত সম্পদ
প্রদীপ দাশের স্ত্রী চুমকি গৃহিণী হলেও দুদকে জমা দেয়া হিসাব বিবরণীতে তাকে মৎস্য খামারি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূলধনে শুরু করা মৎস্য খামারে চুমকি প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। মৎস্য চাষের লাভের টাকায় কিনেছেন চট্টগ্রাম নগরীতে জমি, গাড়ি-বাড়ি।
হিসাব বিবরণীতে চুমকির স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে নগরীর পাথরঘাটা এলাকায় চার শতক জমি (দাম ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা)। ওই জমিতে গড়ে তোলা ছয়তলা ভবন (মূল্য এক কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার); পাঁচলাইশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কেনা হয় ৬ গণ্ডা ১ কড়া ১ দন্ত জমি (দাম এক কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকা); ২০১৭-১৮ সালে কেনা হয় কক্সবাজারে ঝিলংজা মৌজায় ৭৪০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (দাম ১২ লাখ ৩২ হাজার টাকা)। সব স্থাবর সম্পদের মূল্য দেখানো হয়েছে তিন কোটি ৫৯ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা। এছাড়া অস্থাবর সম্পদের মধ্যে দেখানো হয়েছে প্রাইভেটকার (দাম পাঁচ লাখ টাকা), মাইক্রোবাস (দাম সাড়ে ১৭ লাখ টাকা) ও ৪৫ ভরি স্বর্ণ। ব্যাংকে ৪৫ হাজার ২০০ টাকা দেখানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুদকে প্রদর্শিত সম্পদের বাইরে প্রদীপ দাশের চট্টগ্রামের লালখানবাজারে একটি ফ্ল্যাট, কক্সবাজারে দুটি হোটেলের মালিকানা, দেশের বিভিন্ন স্থানে জায়গা-জমি ও ভবন রয়েছে। এছাড়া ভারতের আগরতলা, কলকাতার বারাসাত, গৌহাটিতে তার বাড়ি রয়েছে।
জানা গেছে, প্রদীপ তার অবৈধ আয়ের অর্থ দিয়ে স্ত্রী চুমকির নামে বেশি সম্পদ কিনেছেন। বোয়ালখালীতেও স্ত্রীর নামে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ আছে। সেখানকার সারোয়াতলী এলাকায় প্রদীপের স্ত্রীর নামে রয়েছে মৎস্য প্রজেক্টও।