চট্টগ্রামে খালি কনটেইনারে করে কিশোরের মালেশিয়া যাওয়ার ঘটনায় আবারও প্রশ্ন উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে। তিন দফায় যাচাই-বাছাইয়ের পর খালি কনটেইনার জাহাজে তোলার কথা থাকলেও এখন আদৌ তা করছে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান বন্দর ব্যবহারকারীরা।
তারা বলছেন— বন্দরে আমদানি-রপ্তানিকারকদের কোটি কোটি টাকার পণ্য পড়ে থাকে। বারবার এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি কিংবা গাফিলতি রয়েছে। বন্দরের নিরাপত্তা কর্মী আছে, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে— তারপরও কীভাবে ‘বহিরাগত’ প্রবেশ করে!
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালি কনটেইনার থেকে কিশোরের বিদেশযাত্রার খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পরও নড়চড় নেই বন্দর কর্তৃপক্ষের। ঘটনা জানাজানির চারদিনেও ওই কিশোর কীভাবে কনটেইনারে প্রবেশ করলো তা উদঘাটনে কোন ‘মাথাব্যথা’ নেই তাদের।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে— কেলাং বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বন্দরকে এ ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানায় নি। অভিযোগ পেলে তবেই তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। ওই কিশোরটি সাম্পান নিয়ে মাঝ সমুদ্র থেকে, নাকি বহির্নোঙর কিংবা বন্দর থেকে উঠেছে তা যতক্ষণ পরিস্কার নয় ততক্ষণ বন্দর কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করা সমীচীন হবে না।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালি কনটেইনার তিন ধাপে যাচাই-বাছাই করার পর জাহাজে তোলা হয়। প্রথমে ডিপো কর্তৃপক্ষ কনটেইনার খুলে দেখে। দ্বিতীয়বার কনটেইনারটি বন্দরে নিয়ে যাওয়ার পর নিরাপত্তাকর্মীরা পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর জাহাজে তোলার আগে কনটেইনারের দরজা খুলে দেখেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টরা। তবুও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় নিরাপত্তা শঙ্কার পাশাপাশি বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের সুনামও ক্ষুন্ন বন্দরে সিসিটিভি ফুটেজ আছে, সেগুলা চাইলে কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখে নিজেদের অবস্থান জানাতে পারে তারা।
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন সীতাকুণ্ড বার্তাকে বলেন, ‘কনটেইনারের ভেতর লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার ঘটনার দায় বন্দর ও বেসরকারি ডিপোর কেউই এড়াতে পারেন না। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতির কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। এতে বিদেশে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।’
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সীতাকুন্ড বার্তাকে বলেন, ‘আমরা যখন প্রোডাক্ট বানিয়ে ডিপোতে পাঠাই, ডিপো ঘুরে প্রোডাক্টটা কিন্তু বন্দর হয়েই জাহাজে ওঠে। কাজেই আমাদের মালামালের নিরাপত্তার দায়িত্বটা কিন্তু দিনশেষে বন্দরের উপর। বন্দর আগের চেয়ে অনেক এগিয়েছে, তাদের সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা বজায় রাখা কিন্তু বড় সক্ষমতাগুলোর মধ্যে একটি। একটা ভুলের জন্য কিন্তু সব সফলতা চাপা পড়ে যায়। কাজেই বন্দরের উচিত এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটার জন্য নিরাপত্তার বিষয়টি আরও জোরদার করা। তাহলে আমরা আমাদের সুনামটা ধরে রাখতে পারবো।’
পোর্ট ইউজার্স ফোরামরে সভাপতি মাহবুবুল আলম সীতাকুন্ড বার্তাকে বলেন, ‘বন্দর সীমানায় প্রবেশ করে একটা লোক কনটেইনারের ভেতরে ঢুকে গেল! আবার কনটেইনারে করেই চলে যাওয়া, এটা কি সহজ ব্যাপার? এটা মারাত্মক একটা বিষয়। বন্দরের নিরাপত্তাটা তাহলে কোথায়? নিরাপত্তার বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হওয়া দরকার। নইলে এসব ঘটনা বার বার ঘটবে। ফলে আমাদের দেশে নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে। বহির্বিশ্বে আমাদের সুনাম নষ্ট হবে। বন্দরে আগামীকাল সংসদীয় কমিটির সদস্যরা আসবেন। সেখানেই আমি বন্দরের নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়ে কথা তুলবো। কারণ এটা কিন্তু সহজ বিষয় নয়।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক সীতাকুন্ড বার্তাকে বলেন, ‘যে ছেলেটাকে কনটেইনারের ভেতর থেকে পাওয়া গেছে সে যে বাংলাদেশ থেকে উঠছে এরকম কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। পাশাপাশি মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং থেকে এখনো পর্যন্ত আমরা কোন তথ্য, অভিযোগ বা চিঠিপত্র পাই নাই। এ বিষয়ে আমরা এখনও কিছু জানি না। এটা অফিসিয়ালি জানলে তখনই আমরা তদন্ত করব। তারপর প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।’
বন্দরের নিরাপত্তার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বন্দরের নিরাপত্তা তো শতভাগ জোরদার আছে। প্রথমে বুঝতে হবে এ ঘটনাটা কোন জায়গা থেকে ঘটেছে। সে যদি বন্দরের মাঝখান থেকে ঢুকে পড়ে তখন বোঝা যাবে যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল তাদের অবহেলা থাকতে পারে। আর সে যদি বন্দর থেকেই না ওঠে তাহলে তো বন্দরকে দোষারোপ করার সুযোগ নাই। এখন আগে জানতে হবে ছেলেটা কি বন্দর থেকে ঢুকেছে নাকি বহির্নোঙ্গর থেকে, নাকি মাঝ দরিয়ার মাঝখানে কোন সাম্পান দিয়ে উঠছে। সুতরাং এটা তদন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কাজেই আমরা যখনই এ বিষয়ে চিঠি পাব তখনই আমরা তদন্তে যাবো। আমাদের এখানে কোন গাফিলতি আছে কিনা তা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে কনটেইনারের মুভমেন্ট, ছেলেটা কখন ঢুকেছে সবকিছুই আমরা খতিয়ে দেখব।’
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ৮ জুন ‘এমভি হ্যানসা ক্যালিডোনিয়া’ নামে একটি জাহাজে করে সিঙ্গাপুরযাত্রা করেন এক যুবক। পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল ‘এমভি টাম্পা বে’তে বন্দর কর্মীদের হাতে ধরা পড়ে শ্রীলঙ্কাযাত্রা বিফলে যায় আরেক যুবকের। একইভাবে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এমভি হ্যানসা ক্যালিডোনিয়ার জাহাজে করে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে ধরা পড়েন রিপন নামে আরেকজন। পরে ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর ভারতের বিশাখাপত্তনম বন্দরে একটি খালি কনটেইনার থেকে রোহান হোসেন নামের এক বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে ভারতীয় পুলিশ।
২০১৭ সালের ৩১ জুলাই যুক্তরাজ্যগামী পোশাকের একটি কনটেইনার থেকে বাবুল ত্রিপুরা নামের এক শ্রমিককে উদ্ধার করেন চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা। ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল সিঙ্গাপুর বন্দরে একটি খালি কনটেইনার থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দুজন অস্থায়ী শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে দ্বীন ইসলাম ছিলেন কঙ্কালসার এবং আল আমিন নামের আরেক শ্রমিক ছিলেন মৃত। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর মালয়েশিয়ার পেনাং সমুদ্রবন্দরে চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া খালি কনটেইনারের ভেতর একজনের লাশ পাওয়া যায়। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একটি খালি কনটেইনার করে মালয়েশিয়া যায় রাতুল নামে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর।