আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। তারপরই সবকিছু ছাপিয়ে মরুর বুকে পর্দা উঠছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের। অবসান হচ্ছে সকল আলোচনা-সমালোচনার। নিয়মতান্ত্রিক চার বছরের ব্যবধানে পারস্য উপসাগরের তীরে বিশ্বকাপের এই মহারণে আবার সামিল হতে যাচ্ছে সবাই।
রবিবার (২০ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় কাতারের আল-খোরের আল-বায়াত স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী দিনের একমাত্র খেলায় মুখোমুখি হবে স্বাগতিক কাতার ও ইকুয়েডর।
বিশ্বকাপে কাতারের এটি প্রথম অংশগ্রহণ। স্বাগতিক হিসেবে কাতার সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে আট বছর অনুপস্থিত থাকার পর বিশ্বকাপে ফিরেছে ইকুয়েডর। কাগজে কলমে কাতারের থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে রয়েছে ইকুয়েডর। যে কারণে ম্যাচটিতে জয়ের সম্ভাবনায়ও এগিয়ে রয়েছে সফরকারীরা। দক্ষিণ আমেরিকান বাছাইপর্বে কঠিন চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে ইকুয়েডর চতর্থ স্থান লাভ করেছিলো।
স্বাগতিক হিসেবে ঘরের মাঠের বাড়তি সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে কাতারও প্রস্তুত। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে এ পর্যন্ত কোন স্বাগতিক দল পরাজিত হয়নি। ইতিহাস এদিক থেকে কিছুটা হলেও কাতারের পক্ষে রয়েছে।
১৯৩০ সালে উরুগুয়ে থেকে প্রথম বিশ্বকাপের সূচনা। এরপর থেকেই ৪ বছর অন্তর অন্তর ফুটবলের বিশ্বযুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ আর ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ স্থগিত থাকে। সবচেয়ে পাঁচবার বিশ্বসেরা হয়েছে ব্রাজিল। চার বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জার্মানি আর ইতালি। আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স আর উরুগুয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে দু’বার করে। এক বার করে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে স্পেন আর ইংল্যান্ড। ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে।
বিশ্বকাপের শুরুতে অবশ্য এই ট্রফির নাম ছিলো জুলে রিমে বিশ্বকাপ। চ্যাম্পিয়ন দলকে ওই ট্রফিই দেওয়া হতো। ১৯৪৬ সালে ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমেকে সম্মান জানিয়ে তার নামে ট্রফির নামকরণ করা হয়। ১৯৬৬ সালে এই ট্রফি চুরি হয়ে যায়। সেবার ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জেতার পর ওয়েস্টমিনস্টার হলে ট্রফির প্রদর্শনী করা হয়। ২০ মার্চ ওই হল থেকেই ট্রফি চুরি হয়ে যায়। সাত দিন পর সেই ট্রফি উদ্ধার হয়।
১৯৭০ সালে ব্রাজিল তৃতীয়বার বিশ্বসেরা হওয়ার পর পাকাপাকি ভাবে জুলে রিমে ট্রফি সেলেকাওদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৩ সালে ফের এই ট্রফি খোয়া যায়। ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপের নতুন ট্রফির উন্মোচন হয়। ব্রিটিশ নাগরিক সিলভিও গ্যাজানিগা এই ট্রফির ডিজাইন বানান। বর্তমান এই ট্রফির উচ্চতা ৩৬.৮ সেন্টিমিটার। ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে বানানো হয়েছে বিশ্বকাপ। ৬.১৪২ কেজির মধ্যে ৫ কেজিই সোনা। বিশ্বকাপের ডিজাইন এমন ভাবে তৈরি, দেখলে মনে হবে দু’জন মানুষ হাত দিয়ে পৃথিবীকে স্বাগত জানাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে নতুন বিশ্বকাপ ট্রফির প্রথম ব্যবহার হয়। সে বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল জার্মানি।
এর পর থেকে পাকাপাকি ভাবে কোনও দেশকেই বিশ্বকাপ ট্রফিটি দেওয়া হয় না। চার বছর বিশ্বকাপ ট্রফি নিজেদের কাছে রাখতে পারে কোনও দেশ। এরপর কাপজয়ী দলকে একটি রেপ্লিকা দেওয়া হয়।
এবারের বিশ্বকাপে মোট ৩২টি দেশ অংশগ্রহণ করছে। দেশগুলোকে এ থেকে এইচ পর্যন্ত ৮টি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়েছে। আগামী ২০ নভেম্বর এবারের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে স্বাগতিক কাতার ও ইকুয়েডর। ২১ নভেম্বর ম্যাচ হবে দুটি।এরপর থেকে প্রতিদিন চারটি করে ম্যাচ হবে গ্রুপ পর্বে।
গ্রুপ পর্বের লড়াই শেষে ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে নক-আউট পর্বের ম্যাচ। রাউন্ড অব ১৬ থেকে বিজয়ী দলগুলো কোয়ার্টার ফাইনাল খেলবে আগামী ৯, ১০ ও ১১ ডিসেম্বর। এরপর ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর হবে সেমিফাইনালের ম্যাচ। আগামী ১৮ ডিসেম্বর ফাইনালের পর বিশ্ব খুঁজে পাবে এবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে। এরইসাথে পর্দা নামবে ফিফা বিশ্বকাপের এবারের আসরের।
এবারের বিশ্বকাপ শুধু আয়োজনের দিক থেকেই খরুচে নয়, প্রাইজমানির দিক দিয়েও এবারের বিশ্বকাপকে সেরা বলা চলে। এবারের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নদের প্রাইজমানি শুনলে যে কারোরই চোখ কপালে উঠবে। এবারের চ্যাম্পিয়ন দল বাড়ি নিয়ে যাবে ৪০৪ কোটিরও বেশি টাকা। রানার্স-আপ দল পাবে প্রায় ২৯০ কোটি টাকা। প্রাইজমানি থাকছে শেষ ১৬ নিশ্চিত করা প্রত্যেক দলের জন্যও।
শেষ ১৬ নিশ্চিত করা প্রতিটি দল পাবে বিপুল অঙ্কের প্রাইজমানি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমান। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়া চার দল প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা নিয়ে ঘরে ফিরবে। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান নিশ্চিত করা দল পাবে যথাক্রমে ২৬০ ও ২৪০ কোটি টাকা ।
ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে কাতারের না ছিল কোনো অভিজ্ঞতা, না ফুটবলীয় ইতিহাস, না ছিল কোনো সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু ২০১০ সালে আয়োজক দেশ ঘোষণা হবার পরপরই কাতার সমগ্র বিশ্বকে কথা দিয়েছিল যে বিশ্বকাপ আয়োজন করে সবাইকে চমকে দেবে, প্রযুক্তির দিন বদলে দেবে। কাতার সেই কথা রাখার চেষ্টা করেছে অনেকটুকু। বিশ্বকাপের এবারের আসরে চোখ ধাঁধানো স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে থাকছে নজরকাড়া সব আয়োজন।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্টেডিয়ামে নির্মাণ করতে গিয়ে বানিয়ে ফেলা হয়েছে একটা গোটা শহরই। কোনো কোনো শহরে আবার মেট্রো সার্ভিস চালু করা হয়েছে কেবলমাত্র বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে। আর এই কারণেই এবারের বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যায় বহুল বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপের যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে কাতারের খরচ হয়েছে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩০ লাখ কোটি টাকা। যাগত ৮ বিশ্বকাপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। শুধু বেশি বললে ভুল হবে, গত ২০১৮ রাশিয়া আসরের চেয়ে ২২ গুন বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে এবারের আসরে।
প্রসঙ্গত, ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপ শুরুর ৯২ বছর পর ২০২২ সালে এসে আবারো এক শহরেই হতে যাচ্ছে টুর্নামেন্টের সবগুলো খেলা। কাতারের দোহা শহরেই হবে চলতি আসরের সবগুলো ম্যাচ। দোহা শহরের একমাত্র খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামকেই সংস্কার করে নতুন রূপ দেয়া হয়েছে। বাকি ৭টি স্টেডিয়াম বিশ্বকাপের জন্যই নতুন করে তৈরি করা হয়েছে।