সীতাকুণ্ড- মন জুড়ানো নৈসর্গিক পাঠশালা

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”। জন্মভূমির প্রতি কবির এই শ্বাশত ভালবাসার চিরন্তন সত‍্যতা খুঁজে পাওয়া যায় সীতাকুণ্ডে। প্রকৃতির সাজে সজ্জিত সীতাকুণ্ডের এই ছবি যেন স্বয়ং বিধাতা এঁকেছেন আমাদের জন্য। পাহাড় আর সমুদ্রের মিলন যেন সীতাকুণ্ডের রূপকে করেছে বড্ড বেশি অহংকারী। আশ্চর্য সুন্দরের সৌরভ বর্ণিল ভাবে ছড়িয়ে আছে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন অঙ্গে। সুউচ্চ চন্দ্রনাথ পাহাড়, রহস্যময়তা ভরা পাতালপুরী, ইকোপার্ক, ঝর্নার ছন্দময় গতি, পাহাড়ের কোলে লাবণ্যময় লেক, সী-বিচ এই যেন দৃষ্টির দিগন্ত জুড়ে শুধু মুগ্ধতা। যারা কোলাহলহীন শান্তিময় দিনের প্রত্যাশায় ঘুরে বেড়ান স্বদেশের নানা প্রান্তে তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে সীতাকুণ্ডের পবিত্র ভূমি। সত্যি, চমৎকার পর্যটন শিল্পের জন্য অজস্র দৃশ‍্যবলীর ছড়াছড়ি সীতাকুণ্ডে। বিস্ময় ভরা সুন্দরের বন্দনা যেন শুধু সীতাকুণ্ড কে মানায়।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ঃ আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ” চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মুগ্ধতায় কবি নজরুল লিখেছেন এই গানটি পাহাড়ের ঠিকানায় বসে। প্রকৃতির সব উদাহরণ যেন লুটেপুটে পড়েছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কোলে। প্রায় তেরশ সিঁড়ি বেয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চতায় যখন ঘোষণা করবেন আপনার উপস্থিতি মূহুর্তে উড়ে যায় সকল ক্লান্তি। প্রকৃতির মনখোলা হাওয়ায় নেচে ওঠা হৃদয়ে, সুরতোলা বাতাসের ছন্দে চোখে নেমে আসে শান্তির বারতা। মনে হয় এই যেন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন পূরণ। ঝর্ণার শীতল জলে পা মাড়িয়ে বাড়ন্ত মনের উম্মাদ ছুটাছুটি, গগনবিদারী চিৎকার, সুরে অসুরের গান, সব কিছু মিলে মিশে রচিত হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়। পাখিরা যখন ফিরে নীড়ে, সূর্যের আত্মসমর্পণ পশ্চিমাকাশে। চাঁদের ঝাপসা উপস্থিতি ব‍্যস্ত তখন উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিতে, ধীরে ধীরে চাঁদ স-মহিমায় জ্বলে ওঠে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে। সে সাথে বাড়ছে রাতের গভীরতা, ঝি ঝি পোকার ডাক, তখন ইচ্ছা করে ভরা পূর্ণিমায় রাতের গভীরতা ভেঙ্গে মেতে উঠি প্রাণবন্ত আড্ডায়। তাই কোন এক জোৎস্নার চাদরে ঢেকে থাকা রাতের মুগ্ধতায় আমাদের অমর একুশ গীতির গীতিকার লিখেছেন-“সীতাকুণ্ড পাহাড়ের নিচে চন্দ্রভস্ম জোৎস্না কেন, এখনো আগের মতো মুঠো মুঠো জোনাকি ছড়ায়”।

পাতালপুরীঃ চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার আগেই টুকরো টুকরো পাহাড়ের ঢেউ খেলানো এলোমেলো পথ ধরে ঝর্ণার হিম শীতল জল পায়ে জড়িয়ে এগিয়ে এলেই রহস্য জাগানিয়া পাতালপুরী। যা পর্যটন শিল্পের জন্য একটি দূর্লভ দৃশ্য।

ইকোপার্কঃ বিস্ময়কর এক স্বর্গীয় সবুজ পৃথিবী। গভীর স্নিগ্ধতায় এই সবুজ অরণ্যে হারিয়ে যাবে মন। পাহাড়ের বুক ছিঁড়ে পিচঢালা পথ ধরে এগিয়ে এলেই প্রকৃতির অকৃপণ ভালবাসা উদাত্ত হৃদয়ে স্বাগত জানায় নানা প্রজাতির অজস্র বৃক্ষের দোল খাওয়া পাতার শব্দে রচিত সুরে। প্রাকৃতিক সম্পদের ঐশ্বর্যশালী এই ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে এলেই মনটা হয়ে উঠবে টয়টুম্বুর। সুপ্তধারার নিরন্তর বয়ে চলা জলে আকুল হয় মন। রয়েছে সহস্রধারা জলপ্রপাত। কল কল করে বয়ে চলা জলে তপ্ত দুপুরে সূর্যের ছোঁয়া পেলে রঙধনুর সাত রঙ ছড়ায় সহস্রধারা।

ভাটিয়ারী ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনঃ সীতাকুণ্ডের গর্বের আরেকটি নাম ভাটিয়ারী ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন। পাহাড়ের মায়াবী পথ ধরে হেঁটে যেতেই চোখে পড়ে অপূর্ব লেক। দয়াল স্রষ্টার স্নেহ, মমতা ঝরে পড়ছে ভাটিয়ারীর কোল জুড়ে। এমন নৈসর্গিক রূপের স্পর্শের স্পর্ধা অবাক করে সবাইকে।পাহাড়ের বুক বেয়ে সৌন্দর্যের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভাটিয়ারী লেক তন্বী তরুণীর মতো ছুটে চলে অবিরাম অজানা ঠিকানায়। ভাটিয়ারীর সান্নিধ্যে এলেই মনে হয় এ যেন এক ছবির দেশ। বাউল জালাল উদ্দিনের ভাষায়- দেখলে ছবি পাগল হবি, ঘরে থাকতে পারবি না।
সী- বিচঃ সীতাকুণ্ডকে বলা যায় জল পাহাড়ের দেশ। সাগরের আঁচল জুড়ে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক সী-বিচ। ফৌজদার হাট, ভাটিয়ারী, কুমিরা, বাঁশবাড়িয়া, গুলিয়াখালী সী-বিচ অনায়াসে হরণ করে নিতে পারে যে কারও মন।সমুদ্র পাড়ের বিস্তীর্ণ ঝাউবন, সমুদ্রের ঢেউয়ের উথালপাতাল উঠানামা, কখনো পাল তোলা নৌকার পানি কাটার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ সুর ভরিয়ে দেয় মন। গোধূলির সান্নিধ্যে সূর্য বিদায়ের দৃশ্য দেখে যে কোন পর্যটক বসে পড়বে সুন্দরের ধ্যানে।

সীতাকুণ্ড হচ্ছে প্রকৃতির পাঠশালা। এসে উদার আকাশের বিশালতা থেকে শেখা যায় ভালোবাসা, সমুদ্রের ঢেউ থেকে সুর, পাহাড় আর অরণ্য জুড়ে পাখির কিচিরমিচির শব্দে খুঁজে পাওয়া যায় সুখের সন্ধান।

মোঃ সাইফুর রহমান শাকিল
২০ জুন ২০২০


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *